Tuesday, November 2, 2010

সাথ-সঙ্গতে শিল্পী ও শিল্প বা জলছবির ছবি।

তেলরঙের বস্তুপুঞ্জের ভার এবং স্পেস তথা আয়তন ঘিরে ঘিরে যে দৃষ্টিভার সৃষ্টি করে তার সাপেক্ষে জলরঙের ছবি বিশেষ করে ইউরোপীয় ঘরানার, ইম্প্রেসনিষ্ট কলম যে মায়ার সৃষ্টি করে তার অনেকটাই ব্যক্ত আর অনেকটাই অব্যক্ত। ছেড়ে যাওয়া স্পেস, আলোর আভাস এবং রঙের ঘনত্ব বস্তুপূঞ্জকে চেপে ধরে এবং অনায়াসেই সেই ভার এক অনাবিল শূন্যতায় ভাসিয়ে দিয়ে বস্তুপুঞ্জকে ভরহীনতায় অব্যক্ত কাব্য তূলনায় স্পন্দিত তথা ব্যঞ্জনায় উত্তীর্ণ করে। তাই বোধহয় জলরঙের ছবি বিশেষ করে প্রকৃতির অনুচিত্রন দর্শককে মুগ্ধ বিস্ময়ে অবতীর্ণ করে; যেমনটি করে এক সার্থক কবিতা। তার, ভাষা আমাদের পরিচিত জগৎ থেকে আহরিত হলেও, অপরিচিত অনাবিস্কৃত ব্যঞ্জনায় কবিতা ছেড়ে দেয় অনেকটা জায়গা, সেইখানে পাঠককে নিবদ্ধ করেই যেন তার শান্তি, এক একটা শব্দকে হঠাৎ এক আশ্চর্য্য অর্থব্যঞ্জনায় আবিস্কার করে নিস্তব্ধ করে দেয় সমস্ত জিজ্ঞাসা। একটি ক্ষণ, একটি মূহুর্তের দ্বিধা থর থর চেতনা কি করে সময়ের প্রবাহকে থামিয়ে দিয়ে চিরন্তন হয়ে ওঠে।

অলকেশ ঘোষ, এক বিশিষ্ট শিল্পী। জলরঙই তার শিল্পমাধ্যম। তিনি ছবির রঙ আহরণ করেন প্রকৃতি থেকে। প্রকৃতি বদলে যায়, বদলে যায় তাঁর রঙ নির্বাচন, তাঁর প্যালেট। বস্তুপুঞ্জ ও তার বর্ণ, এই দুয়ে মিলে যে সুষমা তার মধ্যে থেকে বর্ণভাস বিশেষ করে বর্ণের তরলতা এবং তারই অনবরত সন্ধান চলে তাঁর চিত্রে। নদীর পাড়—অদুষ্ট নদীর ধার—তার পাশের জনজীবন, তার ইতিহাস, তার সমাজ অলকেশবাবুর ছবির মুখ্যপাত্র নয়। শিল্পীর তুলিতে ধরা পড়েছে তার নান্দনিক রূপ তথা তার অরূপ—যে রূপ নিয়ে প্রতিদিনের জগতের বর্ণনা; ৪০ বছর ঢাকা শহরে বাস করেও যে জগতের সঙ্গে সহবাসী হওয়া গেল না, রূপের সেই জগৎ অলকেশবাবুর কাছে রিয়ালিস্টিক জগৎ। ব্রহ্মপুত্রের ধারের শৈশবস্মৃতির নিয়ে জামালপুরের সেই বালকটি এখনও খোঁজে সেই অরূপকে, সে রূপ রিয়েলিস্টিক নয় তাই অরূপ, অপরূপ।

মিতবাক, আত্মনিবদ্ধ এবং বা শিল্পী অলকেশ ঘোষকে, তাঁর শৈলী, তাঁর সৃষ্টিকে আমরা জানলাম শবনম ফিরদৌসী’র তথ্যচিত্র—জলছবি’র মাধ্যমে। শবনমের চলচিত্রায়নের একটি ব্যক্তিগত শৈলী রয়েছে, তার ছবি কখনই পরিচালকের দৃষ্টিকোনকে প্রাধান্য দেয়না। ৫০’এর দশকের বিশেষ করে পশ্চিমী ঘরানার নেপথ্যে উচ্চারিত ধারাভাষ্যবাহী তথ্যচিত্র রচনার যে শৈলী তৈরী হয়েছিল, যা সাধারণভাবে তথ্যচিত্রের নির্মানশৈলী হিসাবে সমধিক ব্যবহৃত এবং প্রচলিত; শবনমের শৈলী তার থেকে আলাদা, ইংরাজীতে যাকে বলে নন-ন্যারেটিভ শৈলী তাই।, ফলে ছবির বিষয়বস্তু অনুযায়ী চিত্রায়ন এবং তার পরিবেশন এক বিশিষ্ট চরিত্রের। ৬০-৭০এর দশকে ইউরোপীয় এই শৈলী’র এই মহাদেশে অনেকেই ব্যবহার করেছেন, কিন্তু তথ্যচিত্র অ কাহিনীচিত্রের ভেদরেখা অতিক্রম করার কৌশল তথা প্রকরণ অনেকেই আয়ত্ত করে উঠতে পারেননি। শবনমের এই ছবিটি সেই বিচারে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। ছবির প্রথম দৃশ্য থেকেই, ফস্‌ করে দেশলাই জ্বেলে যে মানুষটি আমাদের সামনে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁর সম্বন্ধে ঔৎসুক্যের যে টানটান আকর্ষণ তৈরী হয়; কোন পূর্ব বিজ্ঞপ্তি, কোন পূর্ব ঘোষনা ছাড়াই তথা কোন নেপথ্য ভাষণ ছাড়াই শুধুমাত্র চিত্রকল্প ও দৃষ্টিকোন নির্বাচনে সাবলীল এবং আন্তরিকভাবেই শিল্পী নিজেকে ও তাঁর শিল্পকর্মকে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থপিত করেন। শিল্পীর সাথে পরিচয় হয়ে যায় আবার একটা ঔৎসুক্যও গঠিত হয়। এই পর্য্যায়ে শিল্পী অ তাঁর সাধনার বর্ণনায় শিল্পীর নিজেরই ভাষ্যে যে সংলাপ তৈরী হয় তার সার্থক সাথ-সঙ্গত রচনা করে চিত্রগ্রহন এবং মোক্ষম সম্পাদনা। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সাথ-সঙ্গত অনেকটা পায়েস রান্নার মতোই—দুধের পাক এবং মিষ্টত্ব এই দুয়ের সঙ্গতে যেমন ঠিক পায়েস হয়ে ওঠে, তেমনই ওস্তাদের তানের সঙ্গে সঠীক মাত্রার তেহাই গানকে উপভোগ্য করে তোলে। শবনমের চিত্রগ্রহন ও সম্পাদনা অলকেশবাবুর ছবির সঙ্গে সাথ-সঙ্গতে সার্থক এবং উপভোগ্য; দুয়ে মিলে। শিল্পীর সামান্য কথায় যে পরিমিতি, চিত্র নির্বাচনে ও সম্পাদনায় সেই একই পরিমিতি—সাথ-সঙ্গত।

শবনম, ছবিটিকে কোন পর্য্যায়ে বা অধ্যায়ে ভাগ করতে সম্ভবতঃ রাজী হবেন না, কিন্তু ছবির মেজাজ এবং গতি অনুযায়ী অথবা বিষয় পরিবর্তনের যে ধারা তার বিচারে যদি ভাগ করা হয় তাহলে, শিল্পী যখন আত্মঅমগ্ন হয়ে দৃশ্যপট নির্বাচনের কথা বলছেন সেই অংশটাই তাঁর ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে একটু ঘন। ইতিমধ্যে, শিল্পীর সঙ্গে যে পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছেন চিত্রপরিচালক তার দাবীতেই মনে হয় আরো একটু যেন শুনতে পারলে ভাল হতো। যে ঔৎসুক্য গড়ে উঠেছে, তার নাটকীয়তা রচনায় শবনমের মুন্সীয়ানা এবং ঐ যে বলছিলাম, তথ্যচিত্র আর কাহিনীচিত্রের বিভাজনরেখার বিলুপ্তি—তারই সুবাদে বেশ কিছু প্রশ্ন তৈরী হয়ে যায়। এই পর্য্যায়েই শিল্পীকে দেখি শহরের প্রেক্ষিতে এবং এই প্রেক্ষিত সম্বন্ধে শিল্পীর মতামতই তাঁকে এবং তাঁর শিল্পশৈলীর যুক্তি তথা বিশিষ্টতাকে ধরিয়ে দেয়। অকলুষিত, অদুষ্ট প্রকৃতির প্রতি এই শিল্পীর আগ্রহ, নিবেদন চিত্রটিকে ব্যক্তিমানুষ সম্বন্ধে তথ্য পরিবেশন থেকে মুক্ত করে, প্রকৃতি ও মানুষের আদিম সম্পর্কের রোমান্টিকতায় পরিবেশ বিপর্য্যয়ের যে সংবাদ গড়ে তোলে তা ব্যক্তি, স্থান ও কালের মাত্রা থেকে উত্তীর্ণ এক আধুনিক বিপর্য্যয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে। আর, এই মাত্রাটিকে স্থায়ী সুরের ব্যঞ্জনা দিয়ে শবনম ছবি শেষ করেছেন দীর্ঘ্য প্যানোরামিক লং শটে আধুনিক শহরের এক কর্ম্যব্যস্ত রাস্তায় গোধূলির নেমে আসার বিষাদের সুরের বিস্তার দিয়ে। এই স্থায়ী সুর রচনায় চিত্রনির্মাতা তাঁর নিজস্ব মন্তব্য উপস্থাপন করেছেন, যা শিল্পী অলকেশ ঘোষের জীবন ও তার শিল্পসাধনা সম্বন্ধে চিত্রনির্মাতার একান্ত মতামত থেকে উত্তীর্ণ হয়ে ব্যক্তি অলকেশ ঘোষ’কে ছাড়িয়ে যায় এবং একটি সাধারণ মন্তব্যে মানুষ ও প্রকৃতির বিরহের সুরটি ধরে ফেলে। চিত্ররচনার বিশিষ্ট শৈলীতে, ছবির শুরু থেকে শিল্পীর ব্যক্তিগত কোন পরিচয়ই দেওয়া হয়নি—শিল্পীর সঙ্গে পরিচিতদের কাছে এই বিষয়টি লক্ষ্যনীয় না হতেই পারে, কিন্তু অপরিচিতদের কাছে এই এক আগ্রহ একটা টান তৈরী করে, ধরে রাখে; আর তার নির্বৃত্তি হয় ছবির শেষাংশে। প্রচলিত প্রথায় ক্রেডিট কার্ডের বদলে আমরা এক চিত্রপ্রদর্শনীর ফেস্টুন থেকে শিল্পীর পরিচয় জানতে পারি এবং তাঁর সম্বন্ধে যে আগ্রহ গড়ে ওঠে তার নির্বাহ ঘটে নাটকীয়ভাবে এবং প্রায় এক কাহিনী চিত্রের আকার পরিগ্রহ করে।

ওয়াহেদ তারেক, ছবির সঙ্গীত রচনা করেছেন। প্রায় নির্বাক এই চিত্রের সাউন্ডট্রাকে সামান্য অথচ অনিবার্য্য সুরের আলাপ ছবির মেজাজ অনুযায়ী পরিবেশিত। সঙ্গীত রচনায় বা সঙ্গীত যন্ত্রের নির্বাচনে, শিল্পীর স্থানিক চিহ্ন ধরা পড়তে পারতো। দেশী সুর বা সারিন্দা কিংবা বাঁশির ব্যবহার কি ছবিকে আরও বিষয় অনুগ হতে সাহায্য করতো? এই জিজ্ঞাসা নিজেকেই করছি, আবহসঙ্গীতের অনবদ্য পরিমিতিকে স্বীকার করেই। অন্যদিকে, পিয়ানোর স্টাকাটো আঘাতই কাম্য, বাঁশীর উদাস রোমান্টিকতার থেকে, হয়তো। ওহাজেদ কামালের চিত্রগ্রহন শান্ত ও নরম রঙ নির্বাচনে বিশেষ করে ডিজিট্যাল ফরম্যাটে যে মুন্সীয়ানার দরকার, সেই ছাপ ও তার অব্যর্থ প্রয়োগ, আগে যে সাথ-সঙ্গতের কথা বলা হয়েছে তা সার্থক করেছে। প্রথম দৃশ্যে, কখনো যদি মনে হয় সফট লেন্স বা ডিফ্যুজড ফোকাসে প্রাথমিক নিসর্গমূলক দৃশ্যাবলীকে জলরঙের আভাস দিতো, ইম্প্রেসনিস্ট ছবির আভাস দিতে পারতো তাহলে এটাও মনে রাখতে হবে যে শবনম তার ছবিতে কারিগরী কৌশল তথা গিমিককে একেবারেই ব্যবহার করেনি। আর তার ফলে সমগ্র ছবি যে ঋজুতা স্বচ্ছতা পেয়েছে তার বোধহয় ব্যঘাত ঘটতো। তবে, ছবির প্রথম দৃশ্যের বৈপরীত্যে সফট ফোকাসে ধরা শহরের ব্যস্ত রাস্তায় সন্ধ্যা নেমে আসার শেষ দৃশ্য এক অসাধারণ সমাপতন। ছবিটি যে সুরে বাঁধা তার ছন্দ ধরে রেখেছে দীর্ঘ্যায়িত লং-শট এবং অব্যর্থ সম্পাদনা। ছবির মেজাজ অনুযায়ী, তারকোভস্কি সুলভ শান্ত সুস্থির আবার কখনো অনিবার্য্যতায় নির্মম। পোর্টেট অঙ্কনরত শিল্পীর ক্লোজ-আপ থেকে শিল্পীর প্রতিকৃতির দৃশ্যাংশে যাওয়ার খন্ডাংশে ছবির সম্পাদনা করেছেন এম এচ পাহালভি, ওয়াহিদ মুরাদের ওস্তাদিটা ধরিয়ে দিতে, বাহবা দিতেই হয়—নিখিল বন্দোপাধ্যায়ের সেতারে ছুট তান শুনে যেমন মুখ থেকে আপনিই বেড়িয়ে যায়—কেয়াবাৎ!

No comments:

Post a Comment